ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪
তালমিছরি

তালমিছরি

Desk | আপডেট : ১৫ জুলাই, ২০১৯ ০১:১৮
তালমিছরি

এই উপমহাদেশে মিছরির ব্যবহার বহুদিন ধরেই হয়ে আসছে। নানা ধরনের আয়ুর্বেদিক ঔষধ হোক কি সাধারণ সর্দি কাশিতে, চিনির মিছরি বা তাল মিছরি সমান ভাবে আজও বিরাজমান বাংলার ঘরে ঘরে। তালুমিছরির কথা শুনলেই যাদের মনে পড়ে সুগার, প্রেশার বা চিনি খাওয়ার যে খারাপ দিকগুলি,তাদের অবগতির জন্য জানাই, বাজারের চলতি চিনি আর মিছরির মধ্যে পার্থক্য আছে। মিছরির গুনাগুণ অপরিসীম।

তবে তার আগে আসুন জেনে নিই তালমিছরি বা চিনির মিছরি কীভাবে তৈরি হয়। তালমিছরি কিন্তু প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি মিষ্টি। যাকে বলে আনপ্রসেসড সুগার। আজকাল সব ধরনের প্রসেসড খাবার এর বিরুদ্ধে সব ডাক্তার থেকে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ সরব। কিন্তু তালমিছরি এই দোষে দুষ্ট নয়। এতে কোনো রকমের ক্ষতিকর উপাদান মেশানো হয় না। ব্লাড সুগার বাড়ানোর জন্য যেটি দায়ী,সেই গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স (GI)স্বাভাবিকভাবে অন্যন্য খাবারে থাকে ৫৫%, কিন্তু তালমিছরিতে তার পরিমাণ মোটে ৩৫%। তাই তালমিছরি খেলে যাদের সুগার আছে তাদেরও সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণ এ থাকে। তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই খাবেন। যাদের সুগার নেই,তারা নিশ্চিন্তে এটি খেতে পারেন।

তালমিছরিতে থাকে খাঁটি তালের রস। সেই তাল গুড় জ্বাল দেওয়া হয় একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এরপরে সেটিকে ঢালা হয় ট্রেতে বা কোনো পাত্রে | এরপরে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এই ট্রেগুলিকে চট দিয়ে ঢেকে রাখা হয় একটি বন্ধ ঘরে। সপ্তাহ খানেক পরে ওপরে ও নিচের অংশগুলি শুকিয়ে দানাতে পরিণত হয়,অর্থাত্‍ তালমিছরিতে পরিণত হয়। মাঝের লেয়ারটি তখনও নরম এবং জলীয় ভাব থাকে এবং সেটিকে বিশেষ উপায়ে আলাদা করে নেওয়া হয়। মিছরি তৈরি করার মৌসুম চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে শ্রাবণের প্রথমার্দ্ধ, এ সময়েই বানানো হয় তালমিছরি। এভাবেই তৈরি হয় আমাদের অতিপরিচিত তালমিছরি।

আসুন,এবারে জেনে নেওয়া যাক,তালমিছরিতে কী কী আছে যার জন্য এটি এত উপকারী?

তালমিছরিতে আছে প্রচুর পরিমাণে এসেনশিয়াল ভিটামিনস,মিনারেলস ( ক্যালশিয়াম, পট্যাশিয়াম, আইরন, জিঙ্ক, ফসফরাস ইত্যাদি) আর আমাইনো এসিডস। একটি অল্প লভ্য ভিটামিন, বি ১২,যা মূলত আমিষাশী খাবারেই পাওয়া যায়, তা পাওয়া যায় এই তালমিছরিতে। এ ছাড়াও এতে আছে ২৪ টি প্রাকৃতিক উপাদান, যার জন্য এটি প্রভূতভাবে আয়ুর্বেদিক ঔষধি তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়।

তালমিছরির উপকারিতা জানেন তোঃ


১।  এনিমিয়া : হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন,তালমিছরিতে প্রচুর পরিমান আয়রন থাকার দরুণ এটা আনিমিয়াতে ভীষণ ভাবে কাজে দেয়। বিশেষত মেয়েদের জন্য তালমিছরি খুব উপকারী। আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিন লেভেল ঠিক রাখতে সাহায্য করে।

২। হাড়ের সমস্যা সমাধান : প্রচুর পরিমাণ ক্যালশিয়াম আর পোট্যাশিয়াম থাকার কারণে তালমিছরি হাড় ও দাঁত শক্ত করে ও হাড়ের সমস্যা দূর করে।মেয়েদের মেনোপজের পরে হাড় ক্ষয় হতে শুরু করে এবং হাড় ভাঙ্গার সমস্যা একটি দৈনন্দিন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এই ক্ষয় রোধ করতে নিয়মিত তালমিছরি সেবন করলে উপকার পাওয়া যায়। এই দুটি কারণের জন্য বাচ্চাদের জন্যও তালমিছরি খুব উপকারী।

৩।  সর্দি কাশির উপশম : তালমিছরির রস কাশি উপশম করতে সাহায্য করে এবং গলায় শ্লেষ্মা নরম করে দেয়, ফলে গলায় খুসখুসানি কমে যায়। এক টুকরো তালমিছরি মুখে নিয়ে চুষলে সর্দিতে এবং কাশিতে আরাম পাওয়া যায়। খুব ছোট বাচ্চাদের জন্য ওষুধ না ব্যবহার করে তালমিছরির প্রয়োগ করে দেখতে পারেন। এটি ঠান্ডা লাগাও প্রতিরোধ করে। কাশতে কাশতে গলায় ব্যথা হলে এক টুকরো তালমিছরি গোলমরিচ আর ঘি দিয়ে পেস্ট বানিয়ে এক চামচ খেলে গলা ব্যাথায় উপকার মেলে। এক চামচ তালমিছরি,গোলমরিচ এবং আমন্ড-এর পেস্ট রোজ রাতে গরম দুধের সাথে খেলে নাকের শ্লেষ্মা বের করে দেয় এবং ঠান্ডা লাগা প্রতিহত করে।

৪। চোখের দৃষ্টি বাড়ায় : বাদাম,মৌরী,তালমিছরি এবং গোলমরিচ এর গুঁড়ো করে রোজ রাতে ১ চামচ করে দুধের সাথে খেলে তা চোখের দৃষ্টি বাড়ায়।

৫। কিডনি স্টোন এর জন্য : পেঁয়াজের রসের সাথে তালমিছরি মিশিয়ে কিছুদিন খেলে কিছুদিনের মধ্যেই প্রস্রাবের সাথে কিডনি স্টোন বেরিয়ে যায় । তালমিছরি কিডনির জন্য উপকারী।

৬। পেটে ব্যথাঃ : তালমিছরি পেটের ব্যথার উপশম এবং পাতলা পায়খানাতে ভীষণ কার্যকরী । নিমপাতার সাথে তালমিছরি খেলে পেটের ব্যথা কমে। ধনে গুঁড়োর সাথে তালমিছরি গুঁড়ো মিশিয়ে জলের সাথে দিনে ২-৩ বার খেলে পাতলা পায়খানা আটকে যায়,বিশেষ করে গরম কালে হিট স্ট্রোক হলে এটি খুব কাজে লাগে।

৭। নাক দিয়ে রক্ত পড়া : অনেকেরই গরমকালে নাক দিয়ে রক্তপাত হয়। নাকের কাছে মিছরি গুঁড়ো করে শুঁকলে রক্তপাতের উপশম হয়।

৮।  মুখের আলসারঃ মুখের আলসারের জ্বালাতে উপশম পেতে তালমিছরি আর এলাচ গুঁড়ো করে পেস্ট করে মুখের ভেতরে লাগালে আরাম পাওয়া যায়। আলসার কমে। বাচ্চাদের জন্যও ব্যবহার করা যায়।

৯। নতুন মায়েদের জন্য : বলা হয়,ব্রেস্ট মিল্ক এর পরিমাণ বাড়ানোর জন্য তালমিছরি খুব উপকারী। কালো তিল এর সাথে তালমিছরি গুঁড়ো করে গরম দুধের সাথে দিনে দুবার খেলে ব্রেস্ট মিল্ক উত্‍পাদনে সহায়তা মেলে।

১০। মাথা ধরা : সাইনাসের জন্য বা চোখের জন্য মাথা ধরা খুব সাধারণ একটি ব্যাপার। বহু মানুষ এই সমস্যায় ভোগেন। আদার রসের সাথে তালমিছরি খেলে সাইনাস জনিত মাথাধরা থেকে উপশম মেলে। তুলসী পাতা, তালমিছরি আর গোটা মরিচ একসাথে খেলেও উপকার পাওয়া যায়।

১১।  কন্সটিপেশন : তালমিছরিতে ডায়েটারি ফাইবারের প্রাচুর্যের জন্য এটি হজমে সাহায্য করে এবং কন্সটিপেশান সারিয়ে তোলে। এছাড়াও,চিনি বা মধুর তুলনায় তালমিছরি আমাদের শরীরে অনেক কম পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট তৈরি করে,ফলে তালমিছরি সেবনে ক্লান্তি অনেক কম হয়, শরীরকে সতেজ রাখে।

১২৷ গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ :গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স তালমিছরিতে চিনি বা মধুর তুলনায় অনেক কম থাকায় তালমিছরি ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে এবং ডায়েবিটিস প্রতিরোধেও সাহায্য করে।

১৩। ডায়রিয়াতে : বার বার পাতলা পায়খানা বা বমি হলে আমাদের শরীর থেকে ইলেক্ট্রোলের মাত্রা কমে যায়। ও আর এস এর পরিবর্তে তালমিছরি জলের সাথে মিশিয়ে বারে বারে খাওয়ালে এই ঘাটতি পূরণ হয় এবং শরীরে এনার্জি ফেরত আসে।

১৪। শিশুদের ব্রেন ডেভেলপমেন্ট : নানা ধরনের প্রাকৃতিক উপাদান এবং ভিটামিন মিনারেল এবং আমাইনো এসিড যুক্ত তালমিছরি বাচ্চাদের নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। ঠান্ডা জনিত বা পেটের রোগ প্রতিহত করতে তালমিছরির জুড়ি নেই। ব্রেন ডেভেলপমেন্ট এর জন্যও তালমিছরি খুব উপকারী।

১৫। আর্থারাইটিস,শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত সমস্যা,স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য ও তালমিছরি খুব উপকারী। তাই নানা ধরনের আয়ুর্বেদিক ওষুধে এই সব সমস্যার সমাধানের জন্য তালমিছরির ব্যবহার বহুদিনের।

উপরে